সিরিজের শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দাপট দেখাল বাংলাদেশ। শেষ ম্যাচে অজিদের চূর্ণ করে ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নিল মাহমুদুল্লা রিয়াদের দল। টি-টোয়েন্টিতে নিজেদের সর্বনিম্ন ৬২ রানে অল-আউট হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া। করোনা কারণে হাজারো শর্ত মেনে মাত্র ৭ দিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে ৫ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। অজিদের শিডিউল এতটাই আঁটসাট যে, আজ রাত ১টায় তারা বাংলাদেশ ছাড়বে। বিমানে ওঠার আগে আরও একবার তাদের হারের স্বাদ পাইয়ে দিল বাংলাদেশ। মিরপুরে শেষ টি-টোয়েন্টিতে আজ টিম টাইগার জয় পেয়েছে ৬০ রানে। এই জয়ে ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ নিশ্চিত করে লড়াই শেষ করল মাহমুদউল্লাহ বাহিনী। অনেক কারণেই এই সিরিজ ইতিহাসে ঢুকে গেল। যে কোনো ফরম্যাট মিলিয়ে এই প্রথম অজিদের বিপক্ষে সিরিজ জিতেছে টাইগাররা।
মাত্র ৬২ রানেই গুটিয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশের ছুড়ে দেয়া ১২২ রানের টার্গেট তাড়া করতে গিয়ে ১৩ ওভারেই সবকটি উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া। ৬০ রানের জয় পেয়েছে স্বাগতিক বাংলাদেশ।
টি-টোয়েন্টিতে এটাই দলটির সর্বনিম্ন রান। এই সংস্করণে আগের সর্বনিম্ন রান ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, সেটি ছিল টি-টোয়েন্টির ইতিহাসের দ্বিতীয় ম্যাচ। ২০০৫ সালে সাউথ্যাম্পটনে ৭৯ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।সাকিবের শততম উইকেট :
সাকিবের প্রথম ওভারেই ফেরালেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ককে। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ৯৯ উইকেট হয়ে গেল সাকিবের। অ্যাশটন টার্নারকে ফিরিয়ে বাংলাদেশের বোলার হিসেবে সাকিব আল হাসান টি-টোয়েন্টিতে পেলেন একশ উইকেটের স্বাদ। ম্যাথু ওয়েডকে ফিরিয়ে মাইল ফলকের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাকিব আল হাসান। পরের উইকেটের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি বাঁহাতি এই স্পিনারকে।
অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে আরও বেরিয়ে যাওয়া বল কাট করেন টার্নার। ক্যাচ যায় সোজা কাভারের ফিল্ডার মাহমুদউল্লাহর হাতে।সবার আগে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে একশ উইকেট পেয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার লাসিথ মালিঙ্গা। সাকিব এই তালিকায় দ্বিতীয়।
সাইফের জোড়া শিকার :
এক ওভারে দুই উইকেট তুলে নিয়েছেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। বোল্ড করে ফেরান অ্যালেক্স কেয়ারি। এক বল পরেই সাইফের সাদামাটা এক ডেলিভারিতে কিপার নুরুল হাসান সোহানকে সহজ ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান মোইজেস হেনরিকেস। দুই ব্যাটস্যমানই খেলেন ৭টি করে বল, রানও সমান ৩।
মাহমুদউল্লাহর উইকেট :
সাকিবের পর বল হাতে এসেই উইকেটের দেখা পান মাহমুদউল্লাহ। নাসুম, নিয়েছেন সাকিবের পর এবার এবার প্রথম ওভারে উইকেট নিলেন মাহমুদউল্লাহও। ক্রিজে থেমে যাওয়া বলে আগেভাগেই শট খেলে ফেলা বেন ম্যাকডারমট ফিরতি ক্যাচ দিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ককে। ৯ ওভারে ৪৮ রান তুলতেই ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলল অস্ট্রেলিয়া।
২ ওভারে ২ উইকেট নাসুমের :
ক্রিস্টিয়ানের পর এবার মিচেল মার্শকেউ ফেরালেন নাসুম আহমেদ। পুরো সিরিজের অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংয়ে আশা ছিলেন মিচেল মার্শ।নাসুমের বলে হয়ে গেলেন এলবিডব্লুই। অফস্টাম্পের দিকে সরে গিয়ে সুইপ করতে গিয়ে মিস করেছেন মার্শ। আম্পায়ার তানভীর আহমেদের সিদ্ধান্ত রিভিউ করেছিলেন, তবে লাভ হয়নি। ১৭ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারিয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
আগের ম্যাচে তিনে নেমে ঝড় তুললেও এবার ওপেন করে তা পারলেন না ড্যানিয়েল ক্রিস্টিয়ান। বিপজ্জনক ব্যাটসম্যানকে বোল্ড করে দিলেন নাসুম আহমেদ।রান তাড়ায় নেমে অজিরাও ওপেনিং জুটিতে পরিবর্তন এনেছিল। গত ম্যাচে পাঁচ ছক্কা মারা ক্রিশ্চিয়ান নামেন ওয়েডের সঙ্গে। দ্বিতীয় ওভারেই ধাক্কা খায় অস্ট্রেলিয়া। ড্যান ক্রিশ্চিয়ানকে (৩) বোল্ড করে দেন নাসুম আহমেদ। ফিরতি ওভারে এসে বিপজ্জনক মিচেল মার্শকে (৪) লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে ফেলেন এই তরুণ স্পিনার। ১৭ রানে দুই উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া। এরপর জুটি গড়ার চেষ্টা করেন ম্যাথু ওয়েড আর ম্যাকডারমট। জুটিতে ২১ রান আসতেই নিজের প্রথম ওভারের তৃতীয় বলে ২২ বলে ২২ রান করা অজি অধিনায়ককে বোল্ড করে দেন সাকিব আল হাসান। এটি তার ৯৯তম টি-টোয়ৈন্টি উইকেট। দলীয় ৪৮ রানে অজিদের চতুর্থ উইকেট পতন ঘটান মাহমুদউল্লাহ। ১৬ বলে ১৭ করা বেন ম্যাকডারমটকে তিনি কট অ্যান্ড বোল্ড করেন। এরপর মঞ্চে আসেন সিরিজে প্রথমবারের মত একাদশে সুযোগ পাওয়া সাইফউদ্দিন। ইনিংসের একাদশ এবং নিজের দ্বিতীয় ওভারের তৃতীয় বলে বোল্ড করে দেন অ্যালেক্স ক্যারিকে (৩)। ৫৩ রানে অজিদের ইনিংস অর্ধেক শেষ হয়। এরপর কেবল আসা-যাওয়ার খেলা। এক বল পরেই তার সাইফউদ্দিনের বল মোইজেস হেনরিক্সের (৩) ব্যাট ছুঁয়ে উইকেটকিপার সোহানের গ্লাভসে জমা পড়ে। এরপরেই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ১০০তম উইকেট শিকার করেন সাকিব আল হাসান। তার বলে মাহমুদউল্লাহর তালুবন্দি হয়ে 'গোল্ডেন ডাক' মারেন অ্যাস্টন টার্নার। সাইফের তৃতীয় শিকার অ্যাস্টন আগার (০)। তিনি সাইফের বলে বোল্ড হলে ৮ম উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া। নাঈমের সঙ্গী হন সাকিব আল হাসান। নবম ওভারের প্রথম বলে 'নো ম্যানস ল্যান্ডে' ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যান সাকিব। আসে ১ রান। পরের বলেই ক্রিশ্চিয়াকে রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে অ্যাস্টন আগারের তালুবন্দি হন নাঈম (২৩)। উইকেটে আসেন সৌম্য সরকার। পাঁচ বল খেলে সিঙ্গেল নিয়ে তিনি রানের দেখা পান। তবে সাকিব (২০ বলে ১১) আজ ব্যাট হাতে ব্যর্থ। অ্যাডাম জাম্পার করা ১০ম ওভারের শেষ বলে তিনি এলবিডাব্লিউ হয়ে যান। টি-টোয়েন্টিতে এই প্রথম এলবিডাব্লিউ হলেন সাকিব। সৌম্যর সঙ্গী হন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। জাম্পাকে ডিপ মিডউইকেট দিয়ে ছক্কা মেরে ভালো কিছুর ইঙ্গিত দেন। কিন্তু না, ১৪ বলে ১ ছক্কায় ১৯ রানে আগার তাকে কট অ্যান্ড বোল্ড করেন। ১৫তম ওভারের পঞ্চম বলে সৌম্যর বিদায়ে দলীয় ৯৬ রানে টাইগারদের ইনিংসের অর্ধেক শেষ হয়। টানা চার ম্যাচ বাজে খেলে একাদশে জায়গা হারিয়েছেন সৌম্য। আজ তার জায়গা হয়েছে চার নম্বর পজিশনে। শুরুতে যথারীতি আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভূগছিলেন। এরপর একটি ছক্কা ও একটি চারে ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দেন। সেই ভিন্ন কিছু আর হলো না। ১৭ বলে ১৬ রান করে ক্রিশ্চিয়ানের বলে লফটেড ড্রাইভ করতে গিয়ে টার্নারের তালুবন্দি হন। চলতি সিরিজে এটাই তার সর্বোচ্চ সংগ্রহ। ১৭তম ওভারে অ্যাডাম জাম্পা দিয়েছেন মাত্র ১ রান।আগের ম্যাচে ঝড় তোলা ক্রিশ্চিয়ানকে এদিন ওপেনিংয়ে নামানোর সিদ্ধান্ত নেয় ১২৩ রানের লক্ষ্যে নামা অস্ট্রেলিয়া। নাসুমের করা দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই বোল্ড হয়ে মাত্র ৩ রানে ফিরে গেলে সেই ফাটকাটা অবশ্য কাজে লাগেনি। ক্রিজে এসে শুরু থেকেই ধুঁকছিলেন সিরিজের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক মিচেল মার্শ। নাসুমের বলে জায়গা বানিয়ে সুইপ করতে গেলে এলবিডব্লিউ হয়ে মাত্র ৪ রানেই ফিরতে হয়ে তাকে, সিরিজে যা তার প্রথম এক অঙ্কের স্কোর। এক প্রান্ত অবশ্য আগলে রেখেছিলেন অধিনায়ক ম্যাথিউ ওয়েড। পাওয়ারপ্লে শেষে ঐ দুই উইকেট হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া তাই তোলে ৩১ রান। তার আগে দুঃস্বপ্নের মত একটা সিরিজ কাটানো সৌম্য সরকার এদিন দলে থাকলেও তার জায়গায় ওপেন করতে নামেন আগের ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্যামিও খেলা মাহেদী হাসান। অস্ট্রেলিয়া তবুও শুরু করেছিল অ্যাশটন টার্নারকে দিয়েই। প্রথম তিন ওভারই করেন তিন স্পিনার। আর সিরিজে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের ওপেনিং জুটিকেও মনে হয় সপ্রতিভ, তিন ওভারে আসে ৩৩ রান। মোহাম্মদ নাইম শেখ দুই স্পিনার অ্যাডাম জাম্পা ও অ্যাশটন অ্যাগারের উপর বেশ চড়াও হয়েছিলেন। তবে পরের ওভারে এসেই নাথান এলিস মাত্র ২ রান দেন। আর সেই চাপ থেকেই হয়ত টার্নারের ওপর পরের ওভারে চড়াও হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখেন মাহেদী। পূর্বপরিকল্পিত শট খেলতে গিয়েই লাফিয়ে ওঠা বলে ব্যাটও হারিয়েছন, বলও তুলে দিয়েছেন আকাশে। ১২ বলে ১৩ রান করেই শেষ হয় মাহেদীকে ওপেন করতে নামানোর পরীক্ষা। তারপরও ওপেনিং জুটিতে এই সিরিজের সর্বোচ্চ ৪২ রান উঠে গেছে তখন। পরের ওভারেও এলিস মাত্র ৩ রান দিলে পাওয়ারপ্লে শেষে এক উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ করে ৪৬ রান। শুরুর ঝড় সামলে অস্ট্রেলিয়ানরা লাগাম টেনে ধরতেও সময় নেননি বেশি। এলিসের পরে ড্যান ক্রিশ্চিয়ানকে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল, সাকিব আল হাসান একবার আকাশে বল ভাসিয়ে বেঁচেও গেছেন। ক্রিশ্চিয়ানের পরের ওভারেই চাপ কমানোর চেষ্টা করতে গেয়ে নাইম চেষ্টা করেছিলেন রিভার্স। পয়েন্টে সহজ ক্যাচ দিয়ে আরও একবার ভাল শুরুর পরেও লম্বা ইনিংস খেলতে পারেননি নাইম, ২৩ বলে ২৩ করে শেষ হয় তার ইনিংস। আর সেই সাথেই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ৭ বছর পর প্রথম উইকেট পেয়েছেন ক্রিশ্চিয়ান, ২০১৪ সালে ভারতের সাথে পেয়েছিলেন শেষ উইকেট। নাইম ফেরার পরে রান বের করতে আরও ধুঁকতে হয় সাকিবকে। জাম্পার নিরীহ একটা সোজা ডেলিভারি ব্যাটে বলে করতে না পেরে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরেন ২০ বলে ১১ রান করে। নিজের ৮২তম ইনিংসে এসে প্রথম এলবিডব্লিউয়ের শিকার হলেন সাকিব, এলবিডব্লিউ না হয়ে তার থেকে বেশি ইনিংস খেলেছেন কেবল ভারতের মহেন্দ্র সিং ধোনি (৮৫)। অপর প্রান্তে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ শুরুটা করেছিলেন দারুণ, জাম্পাকে স্লগ সুইপ করে ডিপ মিডউইকেটের ওপর দিয়ে মেরেছিলেন বিশাল ছয়। তবে অ্যাগারের একটি নিরীহ বলে জায়গা বানিয়ে ফাঁকায় ঠেলে দিতে গেলে টপ এজ হয়ে ১৪ বলে ১৯ রানে শেষ হয় তার ইনিংস।


0 Comments